ক্রায়োনিক্স হলো একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ ঠান্ডা অথবা শীতল। ক্রায়োনিক্স একটি পদ্ধতির নাম যার উদ্দেশ্য হলো কোন মৃত ব্যক্তির আইনত ঘোষণা করা মৃত দেহকে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সংরক্ষিত করা এবং এর মূল উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যতে সেই সংরক্ষিত মৃত দেহকে আবার একটি বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে তাকে পুনর্জীবিত করা। আগেই বলে রাখছি যে সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি না পড়ে কোন মন্তব্য করা বা সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনাদের ঠিক হবে না।
আইনত মৃত বা মৃত্যুর সংজ্ঞা হলো হৃদ যন্ত্রের কার্যক্রম সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়া। কিন্তু গবেষণায় পাওয়া যায় যে এইরকম হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পরেও আমাদের মস্তিষ্ক বা ব্রেইনের কিছু অংশ তখনও জীবিত থাকে। সুতরাং সম্পূর্ণ ভাবে মৃত্যুর যদি ঘোষণা দিতে হয় তাহলে ঐ অবস্থার কার্যক্রম বন্ধ হতে হবে। এখানেই আইনত মৃত্যুর এবং সম্পূর্ণ মৃত্যুর মধ্যে একটা পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। অর্থাৎ সম্পূর্ণ মৃত্যুর ঘোষণা তখনই হবে যখন হৃদ যন্ত্রের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার সাথে মস্তিষ্কের কার্যক্রমও বন্ধ হতে হবে।
ক্রায়োনিক্স পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য হলো হৃদ যন্ত্রের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার পর এবং মস্তিষ্কের কার্যক্রম বন্ধ হওয়ার আগেই তাকে হীমায়িত করে সংরক্ষিত করা যাতে সেই প্রাথমিক ভাবে ঘোষণা করা মৃত ব্যক্তির দেহটিকে একটি বিশেষ পদ্ধতির মাধ্যমে আবার জীবিত করে তোলা যায়।
আমরা নিওরো সার্জিকালে দেখেছি যে প্রাথমিক ভাবে কোন ব্যক্তির হার্ট। অ্যাটাক বা হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার পরেও তাকে বিশেষ হিট করার মাধ্যমেই কখনও কখনও আবার হৃদ যন্ত্রের কার্যক্রম সচল করে তোলার মাধ্যমে সম্ভাব্য মৃত্যুর কাছ থেকে ফিরিয়ে আনতে। ঠিক এই স্থন থেকেই ক্রায়োনিক্স তার গবেষণার কাজ করছে।
আরেকটু পরিষ্কার করে বলি- ক্রায়োনিকসে কর্মরত বিজ্ঞানীদের মতে, “আইনিভাবে মৃত” আর “সম্পূর্ণ মৃত” এর মতো নয়। তারা বলেন যে সম্পূর্ণ মৃত্যু এমন একটি বিন্দু, যেখানে সমস্ত মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে যায়। আইনগত মৃত্যু ঘটে তখন যখন হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু মস্তিষ্কে কিছু কোষীয় কার্যকারিতা রয়ে যায়। ক্রায়োনিক্সের কাজ হলো সেই সামান্য অবশিষ্ট কোষীয় সংরক্ষণ করা, কারণ তাত্ত্বিকভাবে একসময় ঐ ব্যক্তিকে ভবিষ্যতে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে।
ক্রায়োনিক্স পদ্ধতিতে কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার শরীরকে বরফের ভেতরে রাখা হয় কিছুক্ষণ। অঙ্গগুলোকে ভালো রাখতে কৃত্রিমভাবে রক্ত সঞ্চালন করা হয় শরীরের ভেতর দিয়ে। তারপর ক্রায়োপ্রিজারভেশনের জন্য শরীরের ভিতর থেকে রক্ত এবং অন্য জলীয় অংশ যত বেশি পরিমাণ পারা যায় বের করে ফেলা হয়। রক্ত এবং জলীয় অংশের পরিবর্তে অঙ্গ সংরক্ষণের জন্য যে মেডিকেল গ্রেড এন্টি-ফ্রিজ দ্রবণ ব্যবহার করা হয়, সেটা শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় যাতে পরবর্তীতে মৃত শরীরকে ঠান্ডা করা হলেও কোষের ভিতরে ফাটল তৈরি হতে না পারে, কারণ ফাটল তৈরি হলে শরীরের কোষ নষ্ট হয়ে যায়। এরপর একজন মেডিকেল সার্জন বুকের অংশ উন্মুক্ত করে এবং প্রধান রক্তবাহী নালীগুলো থেকেও রক্ত বের করে ফেলার ব্যবস্থা করেন এবং সেখানে একইভাবে মেডিকেল গ্রেড এন্টি-ফ্রিজ দ্রবণ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। যখন মৃতের শরীরের সবগুলো রক্তনালী যথেষ্ট এন্টি-ফ্রিজ দ্রবণে ভর্তি হয়, তখন প্রাথমিক ভাবে ড্রাই আইস (শুষ্ক কার্বন-ডাই-অক্সাইড) ব্যবহার করে প্রাথমিক পর্যায়ে মৃত শরীরের তাপমাত্রা শূন্যের ৭৮.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে নিয়ে আসা হয়, এরপর শুরু হয় তরল নাইট্রোজেন ব্যবহার করে শরীরকে ঠান্ডা করার প্রক্রিয়া। এবং প্রতি ঘণ্টায় শরীরের তাপমাত্রা এক ডিগ্রি সেলসিয়াস করে কমানো হয় এবং এভাবে প্রায় দুই সপ্তাহ পরে শরীরের তাপমাত্রা -১৯৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নিয়ে আসা হয় এবং এই তাপমাত্রায় শরীরকে একটা সিলিন্ডারের মতন চেম্বারে রেখে দেওয়া হয়।
১৯৫৪ সালে শুক্রাণু হিমায়িত করার মাধ্যমে মানব কোষের ক্রাওপ্রিজারভেশন শুরু হয়। মিশরের প্রফেসর রবার্ট এট্টিঙ্গার যখন 'প্রস্পেক্ট অফ ইম্মর্টালিটি' বই লেখেন তখন প্রথম বৈজ্ঞানিকভাবে মানবদেহ ক্রাওপ্রিজারভেশন এর প্রস্তাব দেয়া হয়। ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রথম এটি শুরু হয়। যা ১৯৭৬ সালে এট্টিঙ্গার ক্রাওনিকস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু মৃতদেহ দীর্ঘদিন সংরক্ষণের খরচ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। যার জন্য থেমে যেতে হয়।
মানুষ বা বড় প্রাণীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ দেহকে এভাবে এখনো পর্যন্ত সংরক্ষণের পর পুনর্জীবিত করা না গেলেও মানুষের বিভিন্ন অঙ্গ যেমন- ভ্রূণ থলি, শুক্রাণু, স্টিম-কোষ, গর্ভাশয় এর টিস্যু, ভ্রূণ, ডিম্বাণু, শুক্রাশয়ের টিস্যু ইত্যাদি কে ক্রায়ো-প্রিজারভেশনে রাখার পর তা সফলভাবে পুনরায় সংযোজন করে কর্মক্ষম করে তোলা সম্ভব হয়েছে। তাই আশা রাখা যায় যে ভবিষ্যতে চিকিৎসা শাস্ত্রের উন্নয়ন হলে এক সময় মানুষকেও পুনর্জীবিত করে তোলা সম্ভব হবে বলে ধারণা করছেন একদল বিজ্ঞানী।
ক্রায়োনিকস পদ্ধতির মাধ্যমে সত্যিই কি সম্ভব কোন মানুষকে জীবিত করা?
এখনও সম্ভব হয়নি। কারণ মৃতদেহ সংরক্ষণ করার জন্য অনুমোদন না পাওয়া এবং পেলেও সেটাকে দীর্ঘদিন হীমায়িত করে রাখার জন্য যে অর্থ দরকার তার জোগান। সেই সাথে এই হীমায়িত মৃতদেহগুলোকে আবার সচল করে তোলার জন্য যে পদ্ধতির দরকার এবং প্রযুক্তির দরকার সেটা এখনও গবেষকদের কাছে নেই। যদিও এই পদ্ধতির নিয়ে যারা আগ্রহ দেখাচ্ছেন তাদের বিশ্বাস বিজ্ঞান একদিন এই পদ্ধতির এবং এবং প্রযুক্তির আবিষ্কার করতে পারবে এবং মৃত ব্যক্তির সংরক্ষিত দেহগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে সক্ষম হবে। কিন্তু সেটা কি সত্যিই সম্ভব? আমাদের ভবিষ্যৎ এর উত্তর জানে।
(কিছু তথ্য- উইকি থেকেও সংযোজন করা হয়েছে)