দায়িত্ব
- আব্দুল্লাহ আল মামুন রিটন
সকাল ছয়টা বাজতেই হুড়মুড় করে গোয়ালে ঢোকে রাঘব, ছয়টা গরু আছে ওগুলোর চাড়ি চেক করে দেখে—পানি আছে কি না, যদি কোনোটাতে না থাকে, সেটাতে এক বালতি পানি ঢেলে ভেড়ার পাল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে নদীর চরে নতুন গজানো সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ এলাকার দিকে। ওর কাজ এটাই, ভেড়ার দেখাশোনা করা সন্ধ্যার আগপর্যন্ত। তারপর ভেড়াগুলোকে আবার গোয়ালে রেখে মালিক অরুণ কাকার সঙ্গে দেখা করে বিদায় নেওয়া। বিনিময়ে রাঘবের পরিবারের খরচ বহন করেন অরুণ কাকা।
রাঘব প্রতিদিন সকালে অরুণ কাকার বাড়ি থেকে ভেড়া নিয়ে বের হয়। মাঝেমধ্যে ওর সমবয়সী বেকার যুবক রঞ্জনের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে যেতে হাঁক ছাড়ে, ‘ক্যারে রঞ্জন? আজ কি যাবি আমার সঙ্গে? তোর বউদির বানানো মোলা আছে সাথে।’ হাবাগোবা রঞ্জন বন্ধুর ডাক শুনলেই বেরিয়ে আসে। কোনো দিন না করে না। তবে সে এতটুকু বুঝে যে দুটো মলা বা খই মুড়ির বিনিময়ে আজ সারা দিন ওকে দিয়ে অরুণ কাকার ভেড়াগুলো সে চরিয়ে নেবে।—‘হ্যাঁ রে রাঘব, যাতি হবে নাকি চরে?’
এরপর দুজন ভেড়ার পাল নিয়ে নদীর চরে নতুন গজানো সবুজ ঘাসের বিস্তীর্ণ এলাকার দিকে চলে যায়। চরে একটা বটগাছ আছে। সেটার নিচে রাঘব দুটো মলা রঞ্জনকে দিয়ে ভেড়ার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়—‘রঞ্জন! বন্ধু আমার, জানিস তো খুব বিপদে থাকি, সংসার চলে না অরুণ কাকার টাকায়। শহরের দিকে একটা চাকরির জন্য যেতে হয়, এ জন্যই মাঝেমধ্যেই তোকে ডাকি।’
রঞ্জন মনে মনে ভেড়া গুনতে শুরু করে। কারণ, রাঘবের ওই ডায়ালগ তার মুখস্থ, পরের কাজের জন্য সে তৈরি হতে থাকে। ‘সন্ধ্যার আগেই ফিরো রাঘব, তা না হলে মা আজকেও ধোলাই দেবে!’ রাঘব রঞ্জনের ঘাড়ে একপাল ভেড়ার দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্তে পাশের গ্রামের দিকে রওনা দেয়। কলি নামের একটি মেয়ের বাড়ি সেখানে। তাদের মন দেওয়া-নেওয়া চলছে চার মাস হতে চলল।
এদিকে রঞ্জন দিনভর ভেড়াগুলোর সঙ্গে গল্প করে, আদর করে, দলছুট হলে মায়ের মতো ধরে এনে দলের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বোঝায়। ‘দলছুট হতে নেই বাছা, যার যেমন নিয়ম তার সে রকম নিয়ম মেনেই চলা উত্তম!’ ভেড়ার পালটাও দিনে দিনে বুঝে গেছে রঞ্জন তাদের দলের একজন। তাই বলে ওকেও তারা ভেড়া ভাবে না, ভাবে পিতার মতো একজন বন্ধু। সন্ধ্যার আগেই ভেড়ার দলকে আর ডাকতে হয় না, একে একে রঞ্জনের চারপাশে এসে বসে অপেক্ষা করে—কখন রাঘব এলে বাড়ির পথ ধরবে।
দু-এক দিন পরপরই রাঘব রঞ্জনকে দিয়ে এই খাটুনিটা খাটিয়ে নিচ্ছে। হাবাগোবা রঞ্জনও বন্ধুর সমস্যার কথা মনে করে সহযোগিতার জন্য তার কাজ করে যাচ্ছে। এভাবেই দিন যায়, মাস যায়, নতুন সূর্য উদিত হয়।
এমনই একদিন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই দুটো মুড়ি আর এক গ্লাস চা খেয়ে বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে রাঘব ছুটল অরুণ কাকার গোয়ালঘরের দিকে। গিয়ে দেখল, গরুসহ ভেড়ার পাল আজ নেই। বাড়ির বাগানের একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন অরুণ কাকা আর নতুন কাজের লোক হরেণদা! ‘কাকা গোয়াল ফাঁকা যে! গরু, ভেড়ার পাল কোথায় গেল?’ অরুণ কাকা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন রাঘবের দিকে। ‘কেন? ওগুলো তো রঞ্জন সেই কাক ডাকা ভোরেই নিয়ে গেছে চরের দিকে। বেশ কিছুদিন ধরে দেখছি রঞ্জন ভেড়ার দলটাকে খুব যত্নসহকারে চরায়। যেন আপন সন্তানের মতো। আমি নিজে গিয়ে কদিন দেখেই বুঝেছি, ভেড়ার পালটা ওকে খুব পছন্দ করে। তাই আমি নিজেই আজ থেকে ওর পরিবারের দায়িত্ব নিলাম আর ওকে ভেড়ার দায়িত্ব দিলাম। খুব বিশ্বস্ত হতে গেলে যে গুণ থাকা দরকার, সেটা ওর আছে। এ জন্য তোর ডবল খরচ ওকে দেব বলে দিয়েছি। তুই শহরের দিকে যা, দেখ ভালো চাকরির খোঁজ পাস কি না।’
রাঘব কথা বলতে পারল না। মাথায় হাত দিয়ে ধপাস করে বসে পড়ল। অরুণ কাকা হরেণদার সঙ্গে জমিসংক্রান্ত আলাপ করতে করতে আবার বাগানের দিকে চলে গেলেন।
Tags:
ছোটগল্প