মৌলবাদ: এক বহুমুখী বাস্তবতা - আল মামুন রিটন

মৌলবাদ একটি বহুমুখী ও জটিল ধারণা, যা সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম এবং রাজনীতির গভীরে প্রোথিত। এটি কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত নয়; বরং এটি এমন একটি মানসিকতা যা যেকোনো বিশ্বাস বা মতাদর্শকে চরম রূপে গ্রহণ করতে পারে। "মৌলবাদ" শব্দটি ব্যবহার করে আমরা সাধারণত চরমপন্থা, রক্ষণশীলতা, এবং অন্যের বিশ্বাসের প্রতি অসহিষ্ণুতাকে বোঝাতে চাই। কিন্তু মৌলবাদের প্রকৃত রূপকে অনুধাবন করতে হলে আমাদের বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর বিশ্লেষণ প্রয়োজন।  

প্রথমত, মৌলবাদের উৎপত্তি এবং বিকাশের কথা ভাবলে দেখা যায় যে, এটি কোনো একটি ধর্মের উপর নির্ভরশীল নয়। ইতিহাস বলে, প্রতিটি ধর্মেই একসময় মৌলবাদী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এটি কখনো ধর্মীয় সংস্কার আনার নামে হয়েছে, কখনো রাজনৈতিক বা সামাজিক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। যেমন, মধ্যযুগে ইউরোপে খ্রিস্টান ধর্মীয় চরমপন্থা দেখা গিয়েছিল ক্রুসেডের সময়। একইভাবে ইসলামি ইতিহাসেও কিছু চরমপন্থী গোষ্ঠী আবির্ভূত হয়েছিল, যারা নিজেদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠায় সহিংসতা অবলম্বন করেছিল। অন্যদিকে, হিন্দু, বৌদ্ধ বা ইহুদি ধর্মেও মৌলবাদের নানা রূপ দেখতে পাওয়া যায়। 

মৌলবাদ কেবল ধর্মীয় ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি রাজনৈতিক ও আদর্শিক ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক। মার্কসবাদ, জাতীয়তাবাদ, এমনকি উদারনৈতিকতার মধ্যেও মৌলবাদী প্রবণতা দেখা যায়। যে কোনো আদর্শকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে বিবেচনা করা এবং অন্যদের উপর তা চাপিয়ে দেওয়া মৌলবাদের বৈশিষ্ট্য। উদাহরণস্বরূপ, ফরাসি বিপ্লবের সময় একদল মানুষের ধারণা ছিল যে তারা সমাজকে পরিবর্তন করার একমাত্র সঠিক পথ আবিষ্কার করেছে, এবং যারা তাদের সঙ্গে একমত নয় তারা "শত্রু"। 

তবে মৌলবাদের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো এর "আমরা বনাম তারা" মনোভাব। মৌলবাদীরা তাদের মতাদর্শকে একমাত্র সঠিক পথ মনে করে এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের শত্রু হিসেবে দেখে। এই মনোভাব সমাজে বিভাজন তৈরি করে এবং শান্তি ও সহাবস্থানকে ব্যাহত করে। 

মৌলবাদের বিস্তার সাধারণত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময়ে বৃদ্ধি পায়। মানুষ যখন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, তখন তারা সহজ ও নিশ্চিত উত্তর খোঁজে। মৌলবাদ সেই প্রয়োজন মেটানোর জন্য চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, আধুনিক যুগে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিশ্বায়ন এবং অভিবাসন ইত্যাদির কারণে মানুষের ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ ও সামাজিক কাঠামো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে মৌলবাদীরা সহজ সমাধান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়, যা অনেকেই গ্রহণ করে। 

তবে, মৌলবাদ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? প্রথমত, শিক্ষার মাধ্যমে মানুষকে মতাদর্শগত বহুত্ববাদ শেখানো জরুরি। মানুষকে বোঝাতে হবে যে, একাধিক সত্য থাকতে পারে এবং একমাত্র সত্য দাবি করা আসলে বিভ্রান্তি। দ্বিতীয়ত, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মৌলবাদের বিস্তার কমানো সম্ভব। বৈষম্য, বঞ্চনা এবং নিরাপত্তাহীনতা মৌলবাদের মূলে রয়েছে; এগুলো দূর করলে মৌলবাদ দুর্বল হয়ে পড়বে। 

অতএব, মৌলবাদকে কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত করা এক ধরনের ভুল দৃষ্টিভঙ্গি। এটি আসলে একটি মানবিক দুর্বলতা, যা যেকোনো ধর্ম, আদর্শ বা সম্প্রদায়কে আক্রমণ করতে পারে। সুতরাং, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে কেবল ধর্মীয় সমালোচনার মাধ্যমে নয়, বরং একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহিষ্ণু ও সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।

Post a Comment

COMMENTS

Previous Post Next Post

Fashion & Beauty

কমেন্ট